এইচআইভি এইডস নির্দেশিকা
এইডস কী ? বাঁচতে হলে জানতে হবে।
বর্তমান বিশ্বে এইচআইভি/ এইডস ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়িছে। নিশ্চিতভাবেই এর প্রভাব নতুন প্রজন্ম অর্থাৎ যুবসমাজের উন্নয়নের ধারাকে ব্যাহত করছে। আগামীতে এটি সর্বগ্রাসী রূপ ধারন করবে যদি না এখনই এইডস সম্পর্কে সচেতন হওয়া যায়। ডিসেম্বর ২০০৬- এ ইউএনএইডস-এর তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বে প্রায় চার কোটি মানুষ এইচআইভি আক্রান্ত হয়েছে এবং ৩০ লক্ষ মানুষ এইডস-এ মারা গেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিদিন বিশ্বে প্রায় ১৪০০০ নারী ও পুরুষ এইচআইভি’ তে আক্রান্ত হচ্ছে।এদের মধ্যে অর্ধেকই হলো যুবসমাজ যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৪। যুব সমাজের মধ্যে এই রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এশিয়া মহাদেশেও এ রোগটি মহামারী আকার ধারন করেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে যে কোন দেশের যুবসমাজ তথা আপামর জনসাধারন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই তরুন প্রজন্ম এইচআইভি/এইডস সংক্রন্ত তথ্য, সেবা ও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান আর্থ-সামাজিক বৈষম্য যুবসমাজের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
সার্বিকভাবে বাংলাশে এইচআভি সংক্রমনের হার কম। কিন্তু আমাদের আতœতুষ্টির কোন অবকাশ নেই কেননা সংক্রামনের সকল ঝুঁকিপূর্ন আচরন ও পরিবেশ বিদ্যমান থাকায় এদেশে মহামারী আকারে এইচআইভি/এইডস ছড়িয়ে পড়ার আশংকা খুবই প্রবল। ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য গ্রহন, অনিরাপদ রক্ত সন্বালন, বানিজ্যিক ও ভাসমান যৌন ব্যবসা, ঝুঁকিপূর্ন জনগোষ্ঠী ও সাধারন মানুষের আন্ত ঃসম্পর্ক, অনিরাপদ যৌনমিলন, কনডম ব্যবহারে অনীহা, নারী-পুরুষ বৈষম্য, দারিদ্র, শিক্ষার অভাব, যুব সমাজের মধ্যে নেশার আধিক্য, অপ্রতুল স্বাস্থ্যসেবা, এইচআইভি/এইডস সম্পর্কে সচেতনতা ও তথ্যের অভাব, ব্যাপকভাবে এইচআইভি আক্রান্ত বিভিন্ন দেশের সাথে নিবিড় ভৌগোলিক অবস্থান, দীর্ঘ সীমান্ত এলাকা, শ্রমিক অভিবাসন, মানব প্রাচার ইত্যাদি বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রামনের উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের যুবসমাজ অর্থাৎ দেশের এক তৃতীয়াংশ মানুষ হতে পারে এইডস ভয়াবহতার শিকার।এইডস সম্পর্কে আমাদের যুব সমাজের অধিকাংশেরই সঠিক ধারনা নাই। পাশাপাশি, প্রয়োজনীয় যুববান্ধব স্বাস্থসেবার অপ্রতুলতা এবং স্বাস্থসেবা সম্পর্কিত তথ্যের অভাবে তারা সেবা গ্রহনে র সুযোগ থেকেও বঞ্চিত। যুবসমাজের বিরাট অংশ গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিধায় গার্মেন্টেস শ্রমিকদের এইচআইভি/ এইডস বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভিয়েলাটেক্্র নিজেদের বিভিন্ন ইউনিটগুলিতে নিজস্ব ডাক্তার দ্বারা এই গনসচেতনতামূলক জনকল্যানমূখী কার্য়ক্রম পরিচালনা করে আসছে।
এইচ.আই.ভি কি?
এইচ.আই.ভি হচ্ছে একটি ভাইরাসের নাম।‘এইচ.আই.ভি ’এর পূর্ণ রূপ ‘হিউম্যান ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস’। এর অর্থ হচ্ছে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা লোপকারী ভাইরাস, অথ্যাৎ এই ভাইরাসের সংক্রামনের কারণে মানুষের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা হ্রাস পায়, ফলে মানব দেহ বিভিন্ন রোগ জীবানুর সংক্রামন প্রতিরোধ ব্যর্থ হয় এবং রোগাক্রান্ত হয়।
এইডস, কি ?
‘এইডস’এর পূণরুপ হচ্ছে, ‘অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনো ডেফিসিয়েন্স সিনড্রোম’। এটা হচ্ছে এইচ.আই.ভি সংক্রামনের চুড়ান্ত পর্যায় এবং এ অবস্থায়, আক্রান্ত ব্যক্তির দেহ বিভিন্ন-সুযোগ সন্ধানী রোগ জীবানুর সংক্রমন (যেমন:নিউমোনিয়া,যক্ষা, ক্যাপোসিস মারকোমা, ক্যানড্ডিা ইত্যাদি)প্রতিরোধ করতে পারেনা এবং বিভিন্ন রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে, ধীরে ধীরে আক্রান্ত ব্যাক্তি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
এইচ.আই.ভি কি’/‘এইডস’ বিস্তারের উপায় সমূহ:
- যৌন মিলনের মাধ্যমে
- রক্ত,রক্তজাত সামগ্রী ও সংক্রমিত যন্ত্রপাতির মাধ্যমে
- মা থেকে শিশুতে সংক্রমন
যৌন মিলনের মাধ্যমে সংক্রামন:-
- সুরক্ষা পদ্বতি গ্রহন না করে সংক্রমিত যে কারো সাথেযে কোন ধরেনের যৌন মিলন (যৌনীপথে, পায়ুপথে.মুখে) এইচ.আই.ভি সংক্রামনের এবং ব্যাপক হারে বিস্তরের সবচেয়ে বড় কারণ শতকরা ৯০% এইচ.আই.ভি ছড়ায় এই অরক্ষিত যৌন মিলনের মাধ্যমে।
- যৌন মিলনের মাধ্যমে সংক্রামনের ঝুকি কয়েক গুন বেড়ে যায় যদি যৌন সঙ্গীর কোন প্রজননতন্ত্রেরে ও যৌনবাহিত সংক্রামক রোগ থাকে।
- যৌন মিলনের মাধ্যমে মহিলাদের এইচ.আই.ভি সংক্রামনের হওয়ার ঝুকি তুলনামূলক ভাবে বেশী, কারণ:
- মহিলাদের যৌনঙ্গের দেওয়াল পাতলা এবং তা পুরুষদের যৌনাঙ্গের তুলনায় বেশী এলাকা জুড়ে থাকে তাই পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের এইচ.আই.ভি সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা ২থেকে ৯ গুন বেশী ।
- মহিলারা সাধারনত যৌন বাহিত সংক্রামক রোগের চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত চিকিৎসা প্রদানকারীর কাছে যাওয়ার সুযোগ কম পেয়ে থাকেন এবং অর্ধেকের বেশী মহিলারা রোগের তেমন কোন লক্ষণ থাকেনা বলে তারা চিকিৎসা সেবাও গ্রহন করেন না ।
- দীর্ঘ সময় ব্যাপী কিংবা জবরদস্তিমূলক যৌন মিলনে পুরুষেদের তুলনায় মহিলাদের যৌনঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশী থাকে ,ফলে বীর্যের মাধ্যমে সংক্রমনের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
- মহিলারা তাদের স্বামীদের বিবাহবহির্ভূত যৌন কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রন করতে না পারার কারনে তাদের ঝুকি বেশী থাকে
রক্ত, রক্তজাত সামগ্রী এবং সংক্রমিত যন্ত্রপাতির মাধ্যমে সংক্রমন:
- সংক্রমিত ব্যক্তির রক্ত বা রক্তজাত সামগ্রী (যেমন:প্লাজমা,রক্তজমাট বাঁধার উপাদান,প্যাকসেল ইত্যাদি) কোন সুস্থ্য ব্যক্তি শরীরে গ্রহন করলে,তা গ্রহনকারীর শরীরে এইচ.আই.ভি এর সংক্রামন নিশ্চিত করে।
- সংক্রমিত সূঁচ বা অন্যান্য ডাক্তারী যন্ত্রপাতির জীবানুমুক্ত না করে ব্যবহার করা অত্যন্ত বিপজ্জনক এতে এইচ.আই.ভি সংক্রামনের ঝুকি থাকে অত্যন্ত বেশী।
- জীবানুমুক্ত না করে একই সূঁচ ও সিরিঞ্জ একাধিক ব্যক্তি ব্যবহার করার ফলে শিরার মাধ্যমে মাদক দ্রব্য সেবন কারীদের মধ্যে এইচ.আই.ভি সংক্রামনের ঝুকিও থাকে অত্যন্ত বেশী থাকে যেহেতু শিরায় মাদক দ্রব্য প্রবেশ করানোর আগে সাধারনত কিছু রক্ত সিরিঞ্জ টেনে আনা হয়।
মা থেকে শিশুতে সংক্রমন:
- এইচ.আই.ভি’ ভাইরাস গর্ভাবস্থায়, প্রসবের সময় কিংবা প্রসব পরবর্তীকালে মায়ের কাছে থেকে তার গর্ভের ভ্রƒণে কিংবা শিশুর দেহে সংক্রমিত হতে পারে।
- সংক্রমিত মা থেকে গর্ভাবস্থায় ও প্রসবের পর তার সন্তানের সক্রমিত হওয়ার আশংকা ২০%-৪০%।
- সংক্রমিত মায়ের বুকের দুধের মাধ্যমেও এইচ.আই.ভি’-এর সংক্রমন হতে পারে।
মনে রাখা প্রয়োজন:
- শরীরের অধিকাংশ তরল পদার্থের মধ্যে এইচ.আই.ভি’ ভাইরাস পাওয়া গেলেও সেগুলি কতটা সংক্রামন তা নির্ভর করে উক্ত তরলে ভাইরাসের পরিমানের ও পর।
- চোখের পানি, লালা বা প্রস্রাবের মাধ্যমে এইচ.আই.ভি ছড়ানোর কোন নজির নেই।
সংক্রমিত ব্যক্তির শরীরের যেসব তরল পদার্থ ছোয়াচে, সেগুলো হচ্ছে:
- রক্ত
- বীর্য এবং বীর্যপাতের পূর্বে নির্গত পিচ্ছিল রস
- যৌনা নিঃসৃত তরল পদার্থ
- মায়ের বুকের দুধ
এইচ.আই.ভি যে ভাবে ছড়ায় নাঃ
- সংক্রমিত লোকের ব্যবহ্নত গ্লাসে পানি বা অন্য কিছু পান করলে।
- সংক্রমিত লোকের ব্যবহ্নত পুকুর,সুইমিংপুল বা টয়লেট ব্যবহার করলে।
- সংক্রমিত ব্যক্তিদের সাথে সামাজিক মেলামেশা বা সাময়িক ভাবে অবস্থান করলে, করমর্দন, আলিঙ্গন বা সাধারন চুম্বন করলে।
- হাচি বা কাশির মাধ্যমে।
- মশা বা অন্যান্য রক্তচোষা পোকামাকড় সংক্রমিত ব্যাক্তি রক্তচুষে তারপর সুস্থ কাউকে কামড়ালে।
এইডস এর লক্ষণ সমূহঃ
এইচ.আই.ভি’ ভাইরাস শরীরে প্রবেশের সাথে সাথেই কোন লক্ষন দেখা দেয়না।ভাইরাস শরীরে ঢোকার পর তা ‘এইডস’ এ রুপ নিতে গড়ে ০৮-১০ বছর সময় লাগে। তবে এটা নির্ভর করে ব্যক্তি বিশেষের শারিরীক ও মানসিক সুস্থ্যতা ও রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতার ওপর।‘এইডস’ হলে যে সমস্ত লক্ষণ প্রকাশ পায় তা নিুরুপ:
প্রধান লক্ষণ সমূহঃ
- গত ছয় মাসের মধ্যে শরীরের ওজন শতকরা ১০ ভাগের বেশী কমে যাওয়া।
- একমাসের বেশী সময় ধরে থেমে থেমে বা সার্বক্ষণিক জ্বর।
- একমাসের বেশী সময় ধরে ডায়রিয়া
সাধারন লক্ষণ সমূহঃ
- একমাসের বেশী সময় ধরে ক্রমাগত কাশি।
- সারা শরীরে চুলকানিসহ ত্বকে সংক্রমন।
- বার বার ‘হারপিস জস্টারের’(ঠোটের একধরনের ভাইরাস জনিত ঘা )সংক্রমন
- বার বার মুখে –-গলায় ছত্রাকের সংক্রমন।
- র্দীঘ সময় ধরে এবং ধীরে ধীরে ‘হারপিস সিমপ্লেকক্স’ (বসন্ত) সংক্রমন ছড়িয়ে পড়া।
- সারা শরীরের লসিকা গ্রন্থিফুলে যাওয়া
এইডস-এর চিকিৎসাঃ
- এখন পর্যন্ত‘এইডস’ কোন নিরাময় যোগ্য রোগ নয়। এইচ.আই.ভি এইডস এর ক্ষেত্রে বর্তমানে যেসব ওষধ ব্যবহ্নত হয়, সেগুলি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং রোগ নিরাময় করতে পারেনা।
- এইচ.আই.ভি –এর বিরুদ্ধে কোন কার্যকর টিকাও এখন পর্যন্ত আবিস্কৃত হয়নি।
এইচ.আই.ভি/এইডস থেকে বাঁচার উপায়ঃ
- ধমীয় অনুশাসন মেনে চলা এবং বিবাহ পূবে ও বিবাহ বহি:র্ভূত যৌন সর্ম্পক না করা।
- স্বমী, স্ত্রীর প্রতি এবং স্ত্রী, স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকা।
- একাধিক যৌন সঙ্গী পরিত্যাগ করা এবং সম্ভাব না হলে অবশ্যই সঠিক নিয়মে কনডম ব্যবহার করা।
- যৌন রোগে সমূহের দ্রুত চিকিৎসা করানো।
- ডিসপোজ্যাবল সিরিঞ্জ ব্যবহার করা।
- ডাক্তারী যন্ত্রপাতি সঠিক ভাবে জীবানুমুক্ত করে ব্যবহার করা।
- রক্ত বা রক্তজাত দ্রব্য শরীরে নেওয়ার পূর্বে অব্যশই পরীক্ষা করে নেওয়্
- সংক্রমতি মহিলারা গর্ভধারণ ও শিশুকে স্তন দানের ব্যপারে বিশেষজ্ঞ ডাক্তরের পরামর্শ নেওয়া